বর্তমান সরকার দেওয়ানী কার্যবিধির মতো ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। উক্ত সংশোধনী প্রস্তাবের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে আইনের ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী মহলের মধ্যে চলছে নানান তর্ক-বিতর্ক। এই বিষয়ে নিজের ফেসবুক পোস্টে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তুলে ধরেন সুপ্রীমকোর্ট এর খ্যাতনামা আইনজীবী এবং আইনজীবী নেতা জনাব মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান খান। তার পোস্টটি সরাসরি তুলে ধরা হল্লোঃ
” অন্তর্তবর্তীকালীন সরকার Code of Criminal Procedure (CrPC) তে কিছু সংশোধনী আনতে যাচ্ছে। সংশোধনীর একটি গুরত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ধারা-১৭৩ এর অধীন অন্তবর্তীকালীন তদন্ত প্রতিবেদন। বর্তমান আইনে CrPC-এর সেকশন ১৭৩ অনুযায়ী, পুলিশকে তদন্ত শেষে ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট দাখিল করতে হয়, যেটিকে আমরা সাধারণভাবে পুলিশ রিপোর্ট বলে থাকি। এই রিপোর্ট দুই ধরনের হতে পারে:
চার্জশিট: যেখানে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটকে মামলাটি আমলে নেওয়ার অনুরোধ করে।
ফাইনাল রিপোর্ট: যেখানে পুলিশ উল্লেখ করে যে মামলা মিথ্যা বা অপর্যাপ্ত প্রমাণের কারণে আমলে নেওয়ার উপযোগী নয়।
প্রস্তাবিত নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, এখন পুলিশ চাইলে চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার আগেই একটি ইন্টারিম (অন্তর্বর্তীকালীন) পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করতে পারবে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে আসামিকে ডিসচার্জ (অব্যাহতি) দিয়ে দিতে পারেন। এখানেই মূল উদ্বেগের বিষয়টি তৈরি হচ্ছে।
প্রথমত, মামলার একেবারে শুরুর দিকে চূড়ান্ত তদন্ত ছাড়াই ডিসচার্জের সুযোগ তৈরি হওয়ায়, এতে বিচার বিভাগের ওপর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকি বাড়ছে। ফলে, পুলিশের অপব্যবহার বা দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, এই নতুন ব্যবস্থাটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, বিত্তশালী ও ক্ষমতাবানদের দ্বারা সহজেই অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তারা প্রাথমিক তদন্তে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের পক্ষে ইন্টারিম রিপোর্ট তৈরি করাতে পারে, যাতে মামলার আর কোনো বিচারিক পর্বে না গিয়েই তারা অব্যাহতি পেয়ে যায়।
তৃতীয়ত, পুলিশ কমিশনার, পুলিশ সুপার বা সমমর্যাদার অন্য কোনো পুলিশ অফিসারের আদেশে যেহেতু ইন্টারিম (অন্তর্বর্তীকালীন) পুলিশ রিপোর্ট জমা দিতে হবে, সেক্ষেত্রে তদন্তের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তার যে স্বাধীনভাবে তদন্ত করার ক্ষমতা ছিল, সেটা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
চতুর্থত, যত সৎ উদ্দেশ্যেই এই সংশোধনী আনা হোক না কেন, যতদিন পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীর মধ্যে প্রকৃত ও কার্যকর সংস্কার না আনা যায়, ততদিন এই সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারের পথকে আরো কঠিন করে তুলবে।
এই সংশোধনী যতটা না বিচার প্রক্রিয়ার গতি বাড়াবে, তার চেয়ে বেশি আইনের অপব্যবহার, দুর্নীতি ও প্রভাবশালী মহলের জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং, পুলিশের কাঠামোগত ও নৈতিক সংস্কার নিশ্চিত না করে এমন পদক্ষেপ কার্যকর করা ঝুঁকিপূর্ণ ও আত্মঘাতী হতে পারে।”

Be the first to comment