লিখেছেনঃ গোবিন্দ চন্দ্র দাস

মূল মোকদ্দমা তথা অর্থঋণ মোকদ্দমার রায়কে কার্যকর করার নিমিত্তে ডিক্রিদার/ডিক্রি-হোল্ডার ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান উক্ত রায় ডিক্রি প্রদানকারি আদালতেই নির্ধারিত ফর্মে আবেদন করে, যাকে অর্থঋণ ডিক্রিজারি মোকদ্দমা বলা হয়ে থাকে।
সাধারণত অর্থঋণ মোকদ্দমার ডিক্রিকৃত টাকা পরিশোধ করার জন্য বিবাদীকে ৬০ দিনের সময় দেয়া হয়ে থাকে। উক্ত সময়ের মধ্যে ডিক্রি অনুসারে বিবাদী যদি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধ না করে সেক্ষেত্রে, তার পরবর্তী এক (০১) বছরের মধ্যেই ডিক্রিদার ব্যাংক/ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ডিক্রি প্রদানকারি আদালতে উক্ত ডিক্রিজারি মোকদ্দমা রুজু করিতে হয়।
অর্থজারি মোকদ্দমায় সমনজারি বা ৩০ ধারার নোটিশ জারি সম্পন্ন হলে সাধারণত দুই ধরণের পদক্ষেপ নিতে হয়।
১. যদি ঋণের জামানত বাবদ মর্গেজকৃত/প্লেজকৃত/হাইপোথেকেটেড মালামাল/ স্থাবর সম্পত্তি থাকে তাহলে তা অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর বিধান মোতাবেক নিলাম এর তদ্বীর নিতে হবে। অথবা
২. যদি জামানত হিসেবে কোন সম্পত্তি না থেকে থাকে, তাহলে ৩৪ ধারার বিধান মোতাবেক দেওয়ানী আটকাদেশ এর প্রার্থনা করতে হবে।
আজকের আলোচনা যেহেতু অর্থঋণ আদালতে নিলাম সংক্রান্ত, একারনে আমরা দেওয়ানী আটকাদেশ নিয়ে আলোচনা না করে শুধুমাত্র নিলাম কার্যক্রমের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো।
অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ অনুযায়ী অন্তত পাঁচ (০৫) বার নিলাম করার সুযোগ আছে।
১. ১২(৩) ধারায় (মামলা দায়ের এর পূর্বে ব্যাংকে অনুষ্ঠিত নিলাম)
২. ৩৩(১) ধারায়
৩. ৩৩(৪) ধারায়
৪. ৩৩(৫) ধারায় (অদ্য ধারায় ভোগ দখল এবং বিক্রয় করার অধিকারমূলক সনদ লাভের পর ব্যাংকে অনুষ্ঠিত নিলাম)
৫. ৩৩(৭) ধারায় (অর্থঋন আদালতের ৩৩(৭) ধারায় কোন সম্পত্তির মালিকানা সনদ প্রাপ্তির পর সাধারণত ব্যাংকে নিলামের মাধ্যমেই সেই সম্পত্তি বিক্রি করা হয়)
এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট অর্থঋণ আদালত দুইবার নিলাম কার্যক্রম করতে পারে। যথা: ৩৩(১) এবং ৩৩(৪) ধারায়। সমনজারি সম্পন্ন হলে বা ৩০ ধারার নোটিশ জারি সম্পন্ন হলে নিলামের আবেদন করা যায়। যদি ঋণের জামানত বাবদ প্লেজকৃত /হাইপোথেকেটেড মালামাল বা বন্ধককৃত সম্পত্তি থেকে থাকে তাহলে তা অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর ৩৩(১) ধারার বিধান মোতাবেক নিলাম এর জন্য আদালতে আবেদন দাখিল করতে হবে। অনেক আদালত নিলামের আবেদন করার পর সম্পত্তির বর্তমান মূল্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দান করেন। কোন কোন আদালত সম্পত্তির বর্তমান মূল্য সংক্রান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে সরাসরি নিলামের আবেদন মঞ্জুর করেন। অনেক আদালত উক্ত মূল্যায়ন গ্রহণ করে, কোন শুনানী না কওে, সরাসরি নিলামের আদেশ দান করেন। আবার অনেক আদালত উক্ত মূল্যায়ন দাখিল করার পর, তা গৃহীত হওয়ার জন্য শুনানীর জন্য রাখেন এবং তা অবশ্যই দায়িক পক্ষকে নোটিশ দিয়ে। দায়িক পক্ষ মামলায় কনটেস্ট না করে থাকলে প্রয়োজনে উক্ত নোটিশ আদালতের জারিকারকের মাধ্যমে/ডাক মারফত জারি করাতে হয়, তাতেও না হলে পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে জারি করতে হবে। ধার্য তারিখে দায়িক হাজির না হলে সংশ্লিষ্ট আদালত উক্ত মূল্যায়ন গ্রহণ করতঃ নিলামের আদেশ দান করেন।
এক্ষেত্রে সম্পত্তির বর্তমান মূল্য সংক্রান্ত মূল্যায়ন তদ্বির আদালত ভেদে বিভিন্নভাবে নেয়া হয়ে থাকে। যথা-
১. ডিক্রিদার ব্যাংক / আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্যাডে তফসিল উল্লেখ করতঃ আনুমানিক মূল্য নির্ধারন করে চিঠি / দরখাস্ত আকারে আদালতে দাখিল করতে হয়।
২. একটা দরখাস্ত দিয়ে তাতে আনুমানিক মূল্য উল্লেখ করতঃ সত্যপাঠসহ আদালতে দাখিল।
৩. বন্ধকী সম্পত্তির সংশ্লিষ্ট তফসিলে উল্লেখিত মৌজার সর্বনি¤œ বাজার মূল্যতালিকা বা মৌজারেট ফিরিস্তিযোগে সংযুক্ত করে একটা দরখাস্ত দিয়ে তাতে আনুমানিক মূল্য উল্লেখ করতঃ সত্যপাঠসহ আদালতে দাখিল।
৪. ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিযুক্ত তৃতীয় পক্ষ ভ্যালুয়েটরের রিপোর্ট সংযুক্ত করে তদানুযায়ী একটা দরখাস্ত দিয়ে তাতে আনুমানিক মূল্য উল্লেখ করতঃ সত্যপাঠসহ আদালতে দাখিল।
উপরোক্ত বিষয়াদিতে সন্তোষ হওয়া সাপেক্ষে আদালত নিলামের দরখাস্ত মঞ্জুর করেন। অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর ৩৩(১) ধারার বিধান মোতাবেক নিলাম এর ক্ষেত্রে উক্ত আদালত সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞপ্তিটি কমপক্ষে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এবং প্রয়োজন মনে করলে তদুপরি কমপক্ষে একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশের আদেশ দিতে পারেন। উক্ত বিজ্ঞপ্তিটি নিলামের জন্য ধার্য তারিখের কমপক্ষে ১৫ কার্যদিবস আগে আদেশকৃত পত্রিকায় প্রকাশ করতে হয়।
এখানে আরেকটি ধাপের কথা না বললেই নয় তা হলো- নিলাম ইশতেহার বা নিলাম ঘোষণাপত্র জারী। আদালতভেদে এই ধাপের কার্যক্রমেও কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। একেক আদালতে প্রথা ভেদে এই ধাপটি একেক রকম হয়।
১. অনেক আদালত আগে ঘোষণাপত্র ফেরত আসলে তারপর নিলামের তারিখ নির্ধারণপূর্বক পত্রিকায় প্রকাশের আদেশ দেন।
২. কোন কোন আদালত একই সাথে ঘোষণাপত্র ফেরত এবং নিলামের জন্য পরবর্তী তারিখ ধার্য রাখেন। সেক্ষেত্রে উক্ত তারিখের পূর্বেই তা জারি করতে হয়।
এবার আসুন জেনে নেয়া যাক নিলাম ইশতেহার কী?
নিলাম ইশতেহার বা ঘোষণাপত্র হলো উক্ত আদালতের নেজারতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির নিলাম অনুষ্ঠানের কথা সেই সম্পত্তির উপর ঢোল বাজিয়ে প্রচার করার নিমিত্তে আদালতের একটা আদেশ। যা উক্ত আদালতের নাজির এর প্রতি আদেশিত হয়। নাজির সেই ঘোষণাপত্রটি নিজে বা তার অধীনস্ত একজন জারিকারক এর মাধ্যমে জারি করাইতে পারেন। এই নিলাম ঘোষণাপত্রটি উক্ত জারিকারক তার অধীনস্তক একজন ঢুলিকে সঙ্গে নিয়ে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির উপর গিয়ে ঢোল বাজিয়ে বাজিয়ে ঘোষণা দিয়ে জনগণের মাঝে জারি করে আসেন। (এই প্রথা পুরোনো বাংলা সিনেমায় লক্ষ্য করা যায়, রাজার কোন বানী বা আদেশ ঢোল বাজাতে বাজাতে একজন ঘোষক রাজ্যজুরে জানান দিচ্ছে- অনেকটা এরকম)
এই ধাপটি পাওনাটাকা উদ্ধারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছেন ঢোল বাজিয়ে সঠিকভাবে জারি করতে পারলে দায়িক খুবই ভীত সন্তুস্ত হয়ে পরেন, কেননা তার সম্পত্তিটি চোখের সামনে নিলাম হয়ে বিক্রি হয়ে যেতে পারে। অনেক খেলাপি ঋন গ্রাহক এই পর্যায়ে এসে টাকা পরিশোধ করার জন্য ডিক্রিদার ব্যাংক/ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বরাবর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন।
যাইহোক মূল আলোচনায় আসা যাক। উক্ত নিলামের শর্তসমূহ পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। উক্ত শর্তসমূহ অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ এর ৩৩ ধারার বিভিন্ন উপধারায় বিবৃত আছে। পাঠকদের সুবিধার জন্য উক্ত ধারাটি নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলোঃ
“ ৩৩৷ (১) অর্থ ঋণ আদালত ডিক্রী বা আদেশ জারীর সময় কোন সম্পত্তি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বাদীর খরচে বিজ্ঞপ্তি প্রচারের তারিখ হইতে অন্যুন ১৫ (পনের) দিবসের সময় দিয়া সীলমোহরকৃত টেন্ডার আহ্বান করিবে, উক্ত বিজ্ঞপ্তি কমপক্ষে বহুল প্রচারিত একটি বাংলা জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়, তদুপরি ন্যা বিচারের স্বার্থে প্রয়োজন মনে করিলে স্থানীয় একটি পত্রিকায়, যদি থাকে, প্রকাশ করিবে; এবং আদালতের নোটিশ বোর্ডে লটকাইয়া ও স্থানীয়ভাবে ঢোল সহরত যোগেও উক্ত বিজ্ঞপ্তি প্রচার করিবে৷
(২) প্রত্যেক দরদাতা, উদ্ধৃত দর অনূর্ধ্ব ১০,০০,০০০ (দশ লক্ষ) টাকা হইলে উহার ২০%, উদ্ধৃত দর ১০,০০,০০০ (দশ লক্ষ) টাকা অপেক্ষা অধিক এবং অনূর্ধ্ব ৫০,০০,০০০ (পঞ্চাশ লক্ষ) টাকা হইলে উহার ১৫% এবং উদ্ধৃত দর ৫০,০০,০০০ (পঞ্চাশ লক্ষ) টাকা অপেক্ষা অধিক হইলে উহার ১০% এর সমপরিমান টাকার, জামানতস্বরূপ, ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার আদালতের অনুকূলে দরপত্রের সহিত দাখিল করিবেন।
(২ক) দরপত্র সরাসরি নির্দিষ্ট দরপত্র বাক্সে কিংবা রেজিস্ট্রীকৃত ডাকযোগে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণের মাধ্যমে দাখিল করিতে হইবে।
(২খ) অনূর্ধ্ব ১০,০০,০০০ (দশ লক্ষ) টাকার উদ্ধৃত দর গৃহীত হইবার পরবর্তী ৩০ (ত্রিশ) দিবসের মধ্যে, ১০,০০,০০০ (দশ লক্ষ) টাকা অপেক্ষা অধিক এবং অনূর্ধ্ব ৫০,০০,০০০ (পঞ্চাশ লক্ষ) টাকার উদ্ধৃত দর গৃহীত হইবার পরবর্তী ৬০ (ষাট) দিবসের মধ্যে এবং ৫০,০০,০০০ (পঞ্চাশ লক্ষ) টাকার অধিক উদ্ধৃত দর গৃহীত হইবার পরবর্তী ৯০ (নব্বই) দিবসের মধ্যে, দরদাতা সমুদয় মূল্য পরিশোধ করিবেন এবং তাহা করিতে ব্যর্থ হইলে আদালত জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করিবে।
তবে শর্ত থাকে যে, সংশ্লিষ্ট ডিক্রীদার-আর্থিক প্রতিষ্ঠান লিখিত দরখাস্ত দাখিল করিয়া দায়িকের সুবিধার্থে সময়সীমা বর্ধিত করিবার জন্য অনুরোধ করিলে, আদালত এই উপ-ধারার অধীন নির্ধারিত সময়সীমার অনূর্ধ্ব ৬০ (ষাট) দিবস পর্যন্ত বর্ধিত করিতে পারে।
(২গ) ডিক্রীদারের পক্ষে যদি লিখিতভাবে আদালতকে এই মর্মে অবহিত করা হয় যে, উপ-ধারা (২) এর অধীন দাখিলকৃত দরপত্রে সম্পত্তির প্রস্তাবকৃত মূল্য অস্বাভাবিকভাবে অপর্যাপ্ত বা কম এবং আদালত যদি উহাতে একমত পোষন করে, তাহা হইলে আদালত, কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া, উক্ত দর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিতে পারিবে।
(৩) [উপ-ধারা (২খ) এর অধীনে] জামানত বাজেয়াপ্ত হইলে উহার অর্থ ডিক্রীদারকে প্রদান করা হইবে, ডিক্রীকৃত দাবীর সহিত উক্ত অর্থ সমন্বয় করা হইবে, এবং অতঃপর আদালত, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা কর্তৃক উদ্ধৃত দর এবং পূর্বে বাজেয়াপ্তকৃত জামানত একত্রে সর্বোচ্চ দরদাতা কর্তৃক উদ্ধৃত দর অপেক্ষা কম না হইলে, উক্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে সম্পত্তি নিলাম খরিদ করিতে আহ্বান করিবে; এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা আহুত হইবার পর উপ-ধারা (২খ) এ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সম্পুর্ণ মূল্য পরিশোধ করিবেন এবং তাহা করিতে ব্যর্থ হইলে তাঁহার জামানত বাজেয়াপ্ত হইবে এবং জামানতের উক্ত অর্থ ডিক্রীদারকে ডিক্রীর দাবীর সহিত সমন্বয় করিবার জন্য প্রদান করা হইবে।”
ধারাটি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাবো কিভাবে এবং কোন শর্তে নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। সাধারণত নির্ধারিত ¯ø্যাব অনুযায়ী পে-অর্ডার সংযুক্ত করে আদালত বরাবরে দরখাস্ত আকারে লিখে জাতীয় পরিচয়পত্র সংযুক্ত করে খামে ভরে আদালত নির্ধারিত টেন্ডারবক্সে ফেলতে হয়।
যদি ৩৩ ধারার ১ উপধারার নিলাম কার্যক্রমটি ব্যর্থ হয় অথবা যদি কোন নিলাম খরিদ্দার ৩৩ ধারার ১ উপধারার নিলামে অংশ না নেয় সেক্ষেত্রে উপধারা ৪ অনুযায়ী আবার নিলাম কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে। শর্তসমূহ এবং বাকি সকল কার্যক্রম একই থাকবে, তবে এক্ষেত্রে আরও প্রচারের লক্ষ্যে কমপক্ষে দুইটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এবং আদালত প্রয়োজন মনে করলে তদুপরি কমপক্ষে ০১ টি স্থানীয় দৈনিক প্রত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিটি প্রচারের আদেশ দিতে পারেন।
”৩৩ (৪) কোন সম্পত্তি [উপ-ধারা (১), (২), (২ক), (২খ), (২গ) ও (৩) এর বিধান অনুসারে নিলামে বিক্রয় করা সম্ভব না হইলে, আদালত পুনরায় কমপক্ষে বহুল প্রচারিত ২(দুই)টি বাংলা জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়, তদুপরি ন্যায় বিচারের স্বার্থে প্রয়োজন মনে করিলে স্থানীয় একটি পত্রিকায়, যদি থাকে, উপ-ধারা (১) এর অনুরূপ পদ্ধতিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করাইয়া এবং আদালতের নোটিশ বোর্ডে নোটিশ টাংগাইয়া ও স্থানীয়ভাবে ঢোল সহরতযোগে সীলমোহরকৃত টেন্ডার আহ্বান করিবে; এবং বিক্রয় ও বাজেয়াপ্ত বিষয়ে [উপ-ধারা (২), (২ক), (২খ), (২গ) ও (৩) এ উল্লিখিত বিধান] অনুসরণ করিবে। ”
এর পরেও তথা ৩৩(৪) এর নিলাম ব্যর্থ হলে ৩৩ (৫) এবং ৩৩(৭) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া একবার নিলাম করে ব্যর্থ হওয়ার পর ৩৪ ধারার বিধান অনুযায়ী দেওয়ানী আটকাদেশ এর প্রার্থনা করা যায়। মঞ্জুর হলে দায়িকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরওয়ানা ইস্যু হয়। ৩৩(১) এবং ৩৩(৪) ধারার নিলাম কার্যক্রম ব্যর্থ হলে করণীয় কি তা লেখকের আরেক আলোচনায় উল্লেখিত।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ৩৩(১) এবং ৩৩(৪) ধারায় কতবার নিলাম করা যায়, তা আইনে তথা অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এ সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই। তবে লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত হলো নিলাম কার্যক্রম একবার হয়ে গেলে উক্ত ধারার প্রতিপালন সম্পন্ন হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে আবারও একই ধারার অধীনে পুনরায় নিলাম করলে দায়িকপক্ষের জোড়ালো আপত্তি উত্থাপনের সুযোগ থেকে যায় এবং সেই সূত্র ধরে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার এবং মামলা নিষ্পত্তি করা বিলম্বিত হওয়ার সুযোগ থাকে। যেহেতু যেকোন দেওয়ানী আদালতের সহজাত ক্ষমতা থাকে এবং তার বলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালত পুনর্বার নিলামের আদেশ দিতেই পারেন। তবে এক্ষেত্রে ডিক্রিদার এবং দায়িকের সম্মতি থাকলে, তথা উভয় পক্ষের যৌথ আবেদনের ভিত্তিতে তা করা যেতে পারে।
যেভাবে অর্থঋণ আদালতের নিলামে অংশগ্রহণ করতে হয়ঃ
অর্থঋণ আদালতে দুইবার নিলাম কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। যথা: ৩৩(১) এবং ৩৩(৪) ধারায়। সমনজারি সম্পন্ন হলে বা ৩০ ধারার নোটিশ জারি সম্পন্ন হলে ডিক্রিদার ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিলামের আবেদন করে। আবেদন শুনানি অন্তে সন্তুষ্ট হলে আদালত নিলামের তারিখ ধার্য করিয়া নিলাম অনুষ্ঠানের আদেশ জারি করে। ঋণের জামানত বাবদ প্লেজকৃত /হাইপোথেকেটেড মালামাল বা বন্ধককৃত সম্পত্তি উক্ত অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর বিধান মোতাবেক নিলামের মাধ্যমে খরিদ করা যায়। প্রথম নিলাম অনুষ্ঠিত হয় ধারা ৩৩ এর উপধারা ১ এর বিধান মোতাবেক। উক্ত ৩৩(১) ধারার নিলাম ব্যর্থ হলে, এর পর দ্বিতীয় নিলাম অনুষ্ঠিত হয় ধারা ৩৩ এর উপধারা ৪ এর বিধান মোতাবেক। উক্ত নিলামেও সম্পত্তি ক্রয় করা যায়। উক্ত নিলামে অংশ নিতে হলে জানতে হবে কিছু বিধিবিধান। প্রথমে জেনে নেওয়া যাক কারা নিলামে সম্পত্তি ক্রয় করিতে পারে-
১. যেকোন ব্যক্তি যিনি চুক্তি আইন, ১৮৭২ মোতাবেক চুক্তি করার জন্য উপযুক্ত;
২. যেকোন কোম্পানি
৩. বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান/সংস্থা
সাধারণত বলা যায়- পাগল নয়, ১৮ বছরের নিচে নয়, সুস্থ মষিÍস্ক সম্পন্ন যেকোন মানুষই নিলামে অংশ নিতে পারে। এছাড়া যেকোন নিগমবদ্ধ কোম্পানি সেটা পাবলিক হোক বা প্রাইভেট, বিধিবদ্ধ সংস্থা নিলামের মাধ্যমে জমিজমা/মালামাল ক্রয় করতে পারে।
নিলামের অংশ নেয়ার বিধানাবলি সাধারণত নিলামের বিজ্ঞপ্তিতেই উল্লেখ থাকে। সাধারণ আর দশটা টেন্ডারের থেকে অর্থঋণ আদালতের নিলাম কার্যক্রমে বেশ আলাদা। আসুন জেনে নেয়া যাক বিধিগুলো-
১. নিলাম খরিদ্দার যদি ব্যক্তি হয়, সেক্ষেত্রে সাদাকাগজে অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের প্যাডে আবেদন করতে হবে (আবেদন পত্রের নমুনা লেখকের অন্য লেখায় উল্লেখ আছে)
২. আবেদন পত্রের সাথে ¯ø্যাব অনুযায়ী পে-অর্ডার সংযুক্ত করতে হবে।
‘‘৩৩ (২) প্রত্যেক দরদাতা, উদ্ধৃত দর অনূর্ধ্ব ১০,০০,০০০ (দশ লক্ষ) টাকা হইলে উহার ২০%, উদ্ধৃত দর ১০,০০,০০০ (দশ লক্ষ) টাকা অপেক্ষা অধিক এবং অনূর্ধ্ব ৫০,০০,০০০ (পঞ্চাশ লক্ষ) টাকা হইলে উহার ১৫% এবং উদ্ধৃত দর ৫০,০০,০০০ (পঞ্চাশ লক্ষ) টাকা অপেক্ষা অধিক হইলে উহার ১০% এর সমপরিমান টাকার, জামানতস্বরূপ, ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার আদালতের অনুকূলে দরপত্রের সহিত দাখিল করিবেন।’’
৩. আবেদন পত্রের সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র সংযুক্ত করতে হবে। (নিলামের দিন আদালত প্রয়োজন মনে করিলে অরিজিনালটি দেখতে চাইতে পারেন)
৪. পেপার কাটিং সংযুক্ত করতে হবে (যে পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়েছে উক্ত বিজ্ঞপ্তিটির কপি)
৫. খাকি খামে উপরোক্ত ডকুমেন্টস ভরে তা মোম দিয়ে সীল গালা করে আদালতে রক্ষিত টেন্ডারবক্সে জমা দিতে হবে। (অনেক আদালতে উক্ত টেন্ডারবক্স নেজারত বিভাগে রক্ষিত থাকে আবার অনেক জায়গায় তা অর্থঋণ আদালতের সেরেস্তায় রক্ষিত থাকে)
টেন্ডারবক্স খোলা:
১. সাধারণত নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত সময়ে আদালতের প্রিজাইডিং অফিসার তথা বিজ্ঞ জজ, অর্থ ঋণ আদালত উক্ত টেন্ডারবক্সটি ওপেন কোর্টে নিলামে অংশগ্রহনকারীদের (যদি থাকেন) সামনে খুলে থাকেন।
২. নিলামে অংশগ্রহনকারী কেউ না থাকলেও বিজ্ঞ জজ, অর্থ ঋণ আদালত উক্ত টেন্ডারবক্সটি ওপেন কোর্টে খুলে থাকেন।
৩. বক্সে কোন দরপত্র পরলে, তিনি সেগুলো একটা একটা করে পাঠ করে সবাইকে শোনান।
৪. ঐ সময় কোন দরপত্র দাতা কত টাকা দরপ্রস্তাব করেছেন তা জানা যায়। সুতরাং কে সর্বোচ্চ দরদাতা তা বোঝা যায়।
৫. এরপর বিজ্ঞ জজ, অর্থ ঋণ আদালত জমা প্রাপ্ত দরপত্রসমূহ সম্পর্কে ডিক্রিদার ব্যাংকের মতামত গ্রহণ করেন। যদি ব্যাংকের কোন অথোরাইজড কর্মকর্তা সেই সময়ে উপস্থিত থাকেন তাহলে তিনি সরাসরি/লিখিতভাবে তখনই তার মতামত প্রদান করতে পারবেন। অথবা বিজ্ঞ আদালত পরবর্তীতে একটা তারিখ ধার্য করেন ব্যাংকের মতামত জানানোর জন্য।
৬. যদি নিলামে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ দরে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের কোন আপত্তি না থাকে, তাহলে আদালত নিলাম বহালের জন্য সাধারণত ৩০ দিনের একটা সময় ধার্য করেন।
৭. উক্ত ৩০ দিনের অবসানে উক্ত নিলামটি সর্বোচ্চ দরদাতার নামে বহাল হয়।
৮. যদি ডিক্রিদার ব্যাংক নিলামে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ দরে বিক্রিতে আপত্তি জানায়, সেক্ষেত্রে সাধারণত আদালত উক্ত নিলাম ব্যর্থ গণ্যে পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হন। এক্ষেত্রে ডিক্রিদারের আপত্তি সত্তে¡ও বিজ্ঞ আদালত চাইলে উক্ত দরেই সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারেন। কিন্তু সাধারণত এটা আদালতগুলি করে না। কেননা এতে অনাকাঙ্খিত লিটিগেসনের জন্ম হয়। সময়ক্ষেপন হয়।
নিলাম গ্রহণ প্রসঙ্গে ডিক্রিদারের মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে করণীয়:
নিলামে কোন নিলামকারী অংশগ্রহণ করলে, সর্বোচ্চ প্রদত্ত দরে সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞ আদালত ডিক্রিদার ব্যাংক/ক্ষেত্রমতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতামত গ্রহণ করেন।
১. নিলাম অনুষ্ঠানের দিনই যদি ডিক্রিদার ব্যাংক/ক্ষেত্রমতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যথাযথ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন, তাহলে তিনি লিখিতভাবে বা হলফ সহযোগে মৌখিকভাবে মতামত প্রদান করতে পারেন।
২. যদি উক্ত নিলামের দিনে তা করা সম্ভব না হয়, তাহলে সাধারণত আদালত ডিক্রিদার ব্যাংক/ক্ষেত্রমতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উক্ত মতামত প্রদানের জন্য একটি তারিখ নির্ধারণ করেন।
৩. নির্ধারিত তারিখে সংশ্লিষ্ট ডিক্রিদার ব্যাংক/ক্ষেত্রমতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ দরে নিলাম গ্রহণ বিষয়ে মতামত প্রদান করবে। এক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় ব্যাংককে বিবেচনায় নিয়ে মতামত প্রদান করা সঙ্গত হবে:
ক্স সম্পত্তির বাজার মূল্যের চেয়ে নিলামে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ দর অনেক কম কি না
ক্স সম্পত্তির সর্বনি¤œ বাজারমূল্য / মৌজারেট থেকে কম কি না
ক্স ব্যাংকের সর্বশেষ ভ্যালুয়েসনে (সাম্প্রতিক সময়ের ভ্যালুয়েসন হওয়াই বাঞ্ছনীয়) উল্লেখিত ডিস্ট্রেস ভ্যালুর চেয়ে কম কি না
ক্স উক্ত সম্পত্তির বর্তমান অবস্থা কি, কাদের দখলে আছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা কেমন, ইউটিলিটি কানেকসন আছে কি না, ডোবা, খানা-খন্দ কি না ইত্যাদি
ডিক্রিদার ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ ভ্যালুয়েসনে (সাম্প্রতিক সময়ের ভ্যালুয়েসন হওয়াই বাঞ্ছনীয়) উল্লেখিত ডিস্ট্রেস ভ্যালুর (ফোর্সড সেল ভ্যালু) চেয়ে বা মৌজারেট এর চেয়ে নিলামে প্রাপ্ত দর কম হলে উক্ত সম্পত্তি বিক্রয়ের ব্যাপারে সম্মতিসূচক মতামত না প্রদান করাই সঙ্গত। কেননা, সর্বোচ্চ প্রাপ্ত দর যদি উক্ত দরের চেয়ে কম হয়, সেক্ষেত্রে ডিক্রিদার ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যোগসাজোশের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আবার সব সময় যে ডিস্ট্রেস ভ্যালু বা মৌজারেট এর চেয়ে উত্থিত দর কম হলে ব্যাংক না বোধক মতামত দিতে পারে তা নয়। যথাযথ গ্রহণযোগ্য কারণে সম্মতিসূচক মতামতও দিতে পারে। যথাযথ কারণ হিসেবে নি¤œলিখিত কারণসমূহ উল্লেখ করা যেতে পারে:
১. নদীভাঙ্গন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সম্পত্তির এমন কোন অনিষ্ট সাধন হয় যে তার বাজারমূল্য কমে যায়
২. অনেক সময় দেখা যায় যে, পূর্বের ভ্যালুয়েসনে অসাবধানতাবশতঃ সঠিক মূল্যমান আসেনি
৩. অনেক ক্ষেত্রে পূর্বেও ভ্যালুয়েসনের ক্ষেত্রে প্রতারণা সংঘটিত হয়ে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি
৪. পূর্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মকর্তাদের অসততার কারণে ঋণ গ্রহীতার সাথে যোগসাজশ করে ওভারভ্যালুয়েসন করা হয়েছে
৫. ঋণ গ্রহীতা প্রতারণামূলকভাবে অন্য সম্পত্তি দেখিয়ে ঋণ নিয়েছে, পরবর্তীতে দেখা যায় যে তফসিলভ‚ক্ত সম্পত্তি আসলে অন্যটি যার বাজারমূল্য আদতে কম।
ইত্যাদি বিভিন্ন যথাযথ কারণে ডিস্ট্রেস ভ্যালুর চেয়ে বা মৌজারেট এর চেয়ে নিলামে উত্থিত দর কম হলেও ডিক্রিদার ব্যাংক চাইলে উক্ত সম্পত্তি আদালত কর্তৃক নিলাম বিক্রয়ের ক্ষেত্রে হ্যাঁ-সূচক মতামত দিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করাই শ্রেয়।
নিলামকৃত সম্পত্তির ব্যাপারে আপত্তি প্রসঙ্গে:
অর্থ ঋন আদালত আইন, ২০০৩ যেহেতু দেওয়ানী আইন এবং এটা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, সেহেতু অনেক বিষয়েই দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যেক্ষেত্রে অর্থ ঋন আদালত আইন, ২০০৩ এ সরাসরি বিধান দেয়া আছে, সেক্ষেত্রে সেটাই প্রযোজ্য হবে। কোন বিষয়ে কিছু বলা না থাকলে, সেক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধি ১৯০৮ এর বিধান প্রযোজ্য হবে। যেমনটি অর্থ ঋণ আদালত এর নিলাম এর বিরুদ্ধে আপত্তি সংক্রান্ত বিধান এর বিষয়টির কথা বলা যায়।
কোন সম্পত্তি অর্থ ঋন আদালত আইন, ২০০৩ এর বিধান মোতাবেক নিলাম বিক্রয়ের জন্য উঠলে তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আদালতে আপত্তি দাখিল করা যায়। এক্ষেত্রে দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর অর্ডার ২১ এর বিধি ৮৯, ৯০ ও ৯১ প্রযোজ্য।
কী আছে এই বিধিগুলোতে- আসুন দেখা যাক:
‘অর্ডার ২১ এর বিধি ৮৯: জমা দিয়ে নিলামে বিক্রয় রদের আবেদন।
১) যেক্ষেত্রে ডিক্রি জারিতে স্থাবর সম্পত্তি নিলামে বিক্রয় হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে উক্ত সম্পত্তির মালিক অথবা নিলাম বিক্রয়ের পূর্বে তথায় অর্জিত কোন স্বত্বের অনুবলে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিলাম বিক্রয় রদের জন্য-
ক) ক্রয় মূল্যের শতকরা পাঁচ ভাগের সমান অংক ক্রেতাকে প্রদানের জন্য; এবং
খ) নিলাম বিক্রয়ের উক্ত ইশতেহারের তারিখ হতে ডিক্রিদার কোন পরিমাণ টাকা গৃহীত হয়ে থাকলে তা বিয়োজনপূর্বক যে পরিমাণ টাকা আদায়ের জন্য নিলাম বিক্রয়ের আদেশ হয়েছে বলে নিলাম বিক্রয়ের ইশতেহারে নির্দেশ দেয়া আছে, তা ডিক্রিদারকে প্রদানের জন্য আদালতে জমা দিয়ে আবেদনপত্র দাখিল করতে পারে।
২) যেক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি তার স্থাবর সম্পত্তি নিলাম বিক্রয় রদের জন্য ৯০ বিধির অধীনে আবেদন করে, সেক্ষেত্রে সে তার আবেদন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত এই বিধির অধীনে কোন আবেদন করতে কিংবা পরিচালনা করতে অধিকারী হবে না।
৩) মোকদ্দমার ব্যায়াদি এবং নিলাম বিক্রয়ের ইশতেহারে অনুল্লিখিত না হওয়া কোন খরচা এবং সুদ সম্পর্কিত কোন দায় থেকে দায়িককে এই বিধির কোন বিধানই অব্যাহতি দিবে না।’
‘অর্ডার ২১ এর বিধি ৯০: অনিয়মতা কিংবা প্রতারণার কারণে নিলাম বিক্রয় রদের আবেদন।
যেক্ষেত্রে কোন স্থাবর সম্পত্তি ডিক্রিজারিতে নিলাম বিক্রয় হয়েছে, সেক্ষেত্রে ডিক্রিদার কিংবা সম্পত্তির বণ্টনে আনুপাতিক অংশের অধিকারী কোন ব্যক্তি অথবা উক্ত নিলাম বিক্রয়ের ফলে যার স্বার্থ ক্ষুন্ন হয় ঐ ব্যক্তি নিলাম বিক্রয় রদের জন্য সেটা প্রচার বা পরিচালনার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অনিয়ম বা প্রতারণার অজুহাতে আদালতে আবেদন করতে পারেঃ
তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ অনিয়ম বা তঞ্চকতার কারণে কোন নিলাম বিক্রয় রদ হবে না, যদি না প্রমাণিত তথ্যসমূহের উপর আদালত এ মর্মে পরিতুষ্ট হয় যে, আবেদনকারী উক্ত অনিয়মতা বা তঞ্চকতার অজুহাতে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
‘অর্ডার ২১ এর বিধি ৯১: দায়িকের বিক্রয়যোগ্য স্বার্থ না থাকার অজুহাতে ক্রেতা কর্তৃক বিক্রয় রদের আবেদন।
ডিক্রি জারিতে অনুরূপ কোন নিলাম বিক্রয়ের ক্রেতা উক্ত নিলাম বিক্রয় রদের জন্য আদালতে এ কারণে আবেদন করতে পারে যে, নিলামে বিক্রীত সম্পত্তিতে দায়িকের কোন বিক্রয় যোগ্য স্বার্থ ছিল না।’
এই তিনটি বিধি একসাথে পর্যালোচনা করলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত সম্পত্তির মালিক বা স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তা রদের জন্য আদালতে আবেদন করতে পারবেন।
- ডিক্রিদারের পাওনা টাকা পরিশোধ করে এবং একই সাথে নিলামক্রেতাকে ক্রয়মূল্যের ৫% টাকা পরিশোধ করে
- কোন অনিয়মের অভিযোগে
নিলাম ক্রেতাও নিলাম রদের জন্য আবেদন করতে পারেন নি¤œ লিখিত কারণে:
- উক্ত সম্পত্তিতে দায়িকের কোন বিক্রয়যোগ্য স্বার্থ ছিল না।
নিলাম অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর আদালত সাধারণত ৩০ দিন সময় প্রদান করেন উক্ত নিলাম বহাল করতে। যাতে করে, কেউ উপরিউক্ত বিধি মোতাবেক নিলাম রদের আবেদন করতে চাইলে তা করতে পারেন। যদি কেউ উক্ত বিধিসমূহ মোতাবেক আপত্তি উত্থাপন করে, তাহলে সেইসব আপত্তি নিষ্পত্তি না করে মোকদ্দমা অগ্রসর করা যাবে না। যদি কেউ কোন আপত্তি উত্থাপন না করে, তাহলে আদালত উক্ত নিলাম বহাল করেন।
দরপত্রের বাকি টাকা প্রদানঃ
আদালত নিলাম বহাল করলে, পরবর্তী তারিখে বাকি টাকা দাখিলের জন্য দিন ধার্য করে। কত দিনের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করতে হবে তা ৩৩ (২খ) ধারায় বিবৃত আছে।
‘(২খ) অনূর্ধ্ব ১০,০০,০০০ (দশ লক্ষ) টাকার উদ্ধৃত দর গৃহীত হইবার পরবর্তী ৩০ (ত্রিশ) দিবসের মধ্যে, ১০,০০,০০০ (দশ লক্ষ) টাকা অপেক্ষা অধিক এবং অনূর্ধ্ব ৫০,০০,০০০ (পঞ্চাশ লক্ষ) টাকার উদ্ধৃত দর গৃহীত হইবার পরবর্তী ৬০ (ষাট) দিবসের মধ্যে এবং ৫০,০০,০০০ (পঞ্চাশ লক্ষ) টাকার অধিক উদ্ধৃত দর গৃহীত হইবার পরবর্তী ৯০ (নব্বই) দিবসের মধ্যে, দরদাতা সমুদয় মূল্য পরিশোধ করিবেন এবং তাহা করিতে ব্যর্থ হইলে আদালত জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করিবে।
তবে শর্ত থাকে যে, সংশ্লিষ্ট ডিক্রীদার-আর্থিক প্রতিষ্ঠান লিখিত দরখাস্ত দাখিল করিয়া দায়িকের সুবিধার্থে সময়সীমা বর্ধিত করিবার জন্য অনুরোধ করিলে, আদালত এই উপ-ধারার অধীন নির্ধারিত সময়সীমার অনূর্ধ্ব ৬০ (ষাট) দিবস পর্যন্ত বর্ধিত করিতে পারে।’
অর্থাৎ ১০,০০,০০০/- নিচে হলে ৩০ দিন, ১০,০০,০০০/- থেকে ৫০,০০,০০০/- হলে ৬০ দিন এবং ৫০,০০,০০০/- এর উপর যেকোন এমাউন্টের জন্য ৯০ দিন সময় থাকে। উক্ত সময়ের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে, আদালত উক্ত টাকা বাজেয়াপ্ত করবেন।
তবে, ডিক্রীদার-আর্থিক প্রতিষ্ঠান লিখিত দরখাস্ত দিয়ে দায়িকের সুবিধার্থে সময়সীমা বর্ধিত করার জন্য আবেদন করতে পারে। সেক্ষেত্রে আদালত সর্বোচ্চ ৬০ দিন পর্যন্ত সময় বাড়াতে পারে।
খরিদ্দার কর্তৃক নিলামের সমূদয় টাকা পরিশোধিত হলে পরবর্তী করণীয় কী:
নিলাম খরিদ্দার কর্তৃক নিলামের সমূদয় টাকা পরিশোধিত হলে আদালত বয়নামার খসড়া দাখিল করার জন্য আদেশ প্রদান করেন। উক্ত বয়নামার খসড়া সঠিক হলে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় স্ট্যাম্প পেপারে প্রিন্ট দিয়ে আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মহোদয় তা দাতা হিসেবে স্বাক্ষর করেন। উক্ত স্বাক্ষরিত বয়নামা রেজিস্ট্রেসনের জন্য সেরেস্তাদারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে প্রেরণ করেন।
সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কী হয় ঃ
আদালত একটি মেমো দিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার বরারর সেরেস্তাদারের মাধ্যমে পাঠালে, সেই চিঠি প্রাপ্ত হয়ে তা নির্ধারিত ভল্যুয়ম বহিঃতে রেজিস্ট্রি করে যথাযথভাবে দলিলের নম্বও প্রদান করে এস আর ও টোকেনসহ ফিরতি মেমো দিয়ে চিঠির মাধ্যমে তা সংশ্লিষ্ট আদালতকে অবহিত করেন। এক্ষেত্রে নিলাম ক্রেতা প্রয়োজনে উক্ত বয়নামা দলিলের সইমুহুরী নকল উত্তোলন করে নিতে পারে।
দখলী পরওয়ানা:
রেজিস্ট্রেসন কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পাদন হবার পর, নিলাম খরিদ্দারের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত সংশ্লিষ্ট নিলামে বিক্রীত সম্পত্তি আদালতের নেজারতের মাধ্যমে ক্রেতা বরাবর দখল দিয়ে থাকেন। আদালত নির্ধারিত তারিখ উল্লেখপূর্বক আদালতের নাজির বরাবর দখলী পরওয়ানা ইস্যু করেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজন বিবেচনায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে এবং পুলিশ ফোর্সের সহযোগিতায় দখল বুঝে নেয়ার আবেদন করলে, আদালত তা মঞ্জুর করেন। অনেক সময় বিক্রীত সম্পত্তির চৌহদ্দি বা পরিমাপ সংক্রান্ত জটিলতা থাকলে আদালতে দরখাস্ত দিয়ে মঞ্জুর করা সাপেক্ষে একজন এ্যাডভোকেট সার্ভে কমিশনার নিয়োগ করা যায়। দখলের দিন নির্ধারিত পন্থায় ক্রেতা বরাবর উক্ত সম্পত্তির দখল অর্পণ করা হয়। সাধারণত নেজারতের নির্দেশ মোতাবেক একজন ঢোল বাদক ঢোল বাজিয়ে ঘোষণাপত্র পাঠ করে নতুন ক্রেতার দখল ঘোষণা করেন।
ক্রেতা বরাবর উক্ত জমির দলিলপত্রাদি হস্তান্তর:
দখলী পরওয়ানা যথাযথভাবে আদালতে ফেরত আসলে, আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে হয়ে অথবা নিলাম ক্রেতার আবেদনের প্রেক্ষিতে ডিক্রিদার ব্যাংক / আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জমির মালিকানা সংক্রান্ত মূল কাগজপত্র আদালতের মাধ্যমে ক্রেতা বরাবর হস্তান্তরের নির্দেশ প্রদান করেন।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক টাকা উত্তোলনঃ
মূল কাগজ পত্র জমা দেওয়ার পর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আবেদনক্রমে বিজ্ঞ আদালত নিলাম খরিদ্দার কর্তৃক জমাকৃত সমস্ত পে-অর্ডার/চেক/ব্যাংক ড্রাফ্ট উক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে প্রদান করেন।
আর এর মধ্য দিয়েই অর্থঋণ আদালতে নিলাম কার্যক্রমের পরিসমাপ্তি ঘটে।

লেখক পরিচিতিঃ একটি প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে আইন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত (gobindadas1802@gmail.com)
Be the first to comment